১৯৯৮ সাল। কলকাতা ফুটবলে ঘটেছিল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। মোহনবাগান এবং ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে স্পনসরশিপ চুক্তি করেছিল বিজয় মালিয়ার মালিকানাধীন ইউনাইটেড ব্রিউয়ারিজ (ইউবি) গ্রুপ।
এই চুক্তির মাধ্যমে কলকাতার অন্যতম দুই প্রাচীন ফুটবল ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল কর্পোরেট দুনিয়ার কোনো বড় সংস্থা। যদিও তাতে সবাই খুশি হতে পারেননি। ইউবি গ্রুপ মূলত অ্যালকোহলের ব্যবসা করে। এরকম একটি সংস্থার সঙ্গে স্পনসরশিপ চুক্তি মেনে নিতে পারেননি ইস্টবেঙ্গল এবং মোহনবাগানের অনেকে সদস্য, সমর্থক। এছাড়া অভিযোগ উঠেছিল, ক্লাবের প্রশাসনে হস্তক্ষেপ করছে ইউবি গ্রুপ। এর আগে মোহনবাগান এবং ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল টাটা টি এবং খাদিমস। তবে এই সংস্থাগুলির সঙ্গে ক্লাবের কোনো অংশীদারিত্বের চুক্তি হয়নি।
ইস্টবেঙ্গলের স্পনসর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে একটি সংস্থা তৈরি করেছিল ইউবি গ্রুপ, যার নাম ছিল কিংফিশার ইস্টবেঙ্গল ফুটবল টিম প্রাইভেট লিমিটেড। এই সংস্থার মালিকানা ৫০ শতাংশ করে ছিল উভয় পক্ষের কাছে। অন্যদিকে ইউবি গ্রুপের সহযোগী সংস্থা ইউনাইটেড স্পিরিটস লিমিটেড (ইউএসএল) একই রকমভাবে মোহনবাগানের সঙ্গে একটি সংস্থা তৈরি করেছিল। এর নাম ছিল ইউনাইটেড মোহনবাগান প্রাইভেট লিমিডেট। এখানেও উভয় পক্ষের কাছে ৫০ শতাংশ করে ছিল মালিকানা। ইউবি গ্রুপের সঙ্গে এই চুক্তির পর কলকাতার দুই প্রাচীন ক্লাব সাফল্যের স্বাদও অনুভব করেছিল। কারণ এই দুই ক্লাব হয়ে উঠেছিল ভারতীয় ফুটবলে সর্বাধিক অর্থ খরচকারী দুই ক্লাব।
তবে পরিস্থিতি দ্রুত বদলাতে থাকে। ২০০০ সালের ঘটনা। ইউবি গ্রুপ হঠাৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে উভয় ক্লাবের টিম বাজেট ১ কোটি টাকারও বেশি কমানো হবে। মাঠে ইস্টবেঙ্গলের খারাপ পারফরমেন্সের জন্য এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ইউবি গ্রুপ। অন্যদিকে মোহনবাগানের মাঠের বাইরের নানা সমস্যা এবং আইনী লড়াইয়ের কারণে তখন লিকার ফার্মের সময়টাও খুব একটা ভালো যাচ্ছিল না। ইউবি গ্রুপ তাদের বিনিয়োগ অর্থরাশির পরিমাণ হ্রাস করার ফলে সমস্যায় পড়ে দুই ক্লাব। ইউবি গ্রুপের বিমান সংস্থা কিংফিশার এয়ারলাইন্স বিশাল লোকসান করে। ২০১২ সালে বন্ধ হয়ে যায় এই বিমান সংস্থা। এর পর ইউবি গ্রুপ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের খরচ কমানোর প্রক্রিয়া শুরু করে। ২০১২ সালে ইস্টবেঙ্গল এবং মোহনবাগানের বাজেটে কাটছাঁট করার প্রস্তাব পেশ করে ইউবি গ্রুপ।
২০১৩ সালে দুই ক্লাবের সঙ্গে নতুন করে চুক্তি স্বাক্ষর করে এই সংস্থা। এই নতুন চুক্তি অনুযায়ী, ১০ বছরের সময়কালে তাদের ৮০ কোটি টাকা দেওয়ার কথা ঘোষণা হয়। তবে ২০১৪ সালে ইউবি গ্রুপের ইউএসএলে যখন ব্রিটিশ মাল্টিন্যাশনাল পানীয় সংস্থা ডিয়েগো পিএলসি মালিকানা (৫৪.৮ শতাংশ) অধিগ্রহণ করে, তখন প্রবল আর্থিক সমস্যায় পড়েছিল মোহনবাগান। রিপোর্টে দাবি করা হয়, সবুজ মেরুণ শিবিরের সঙ্গে স্পনসর হিসেবে থাকতে অনীহা প্রকাশ করে এই ব্রিটিশ সংস্থা। এই অবস্থায় ২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে তারা ফান্ডিং বন্ধ করে দেয়। ২০১৪-১৫ মরসুমে আইলিগের খেতাব জিতেছিল মোহনবাগান। তবুও তখন ক্লাবের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। ২০১৩ সালের চুক্তি অনুযায়ী যে অর্থরাশি প্রদানের কথা ছিল, এক বছর ধরে তা না পাওয়ার পর চিফ স্পনসরের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন মোহনবাগানের আধিকারিকরা। ২০১৫-১৬ আইলিগ মরসুমে ম্যাকডোয়েলসের লোগো দেওয়া জার্সি পরতে রাজি হয়নি ক্লাব। শেষ পর্যন্ত ২০১৬ সালের শেষ নাগাদ এই চুক্তি নির্ধারিত মেয়াদের আগেই সমাপ্ত হয়। এই ব্যাপারে সম্মতি প্রকাশ করা হয় যে ইউএসএল তাদের ৫০ শতাংশ মালিকানা ফেরত দেবে জয়েন্ট ভেঞ্চার থেকে। টাইটেল স্পনসর ছাড়া চারটি মরসুম কাটানোর পর অবশেষে আইএসএল চ্যাম্পিয়ন এটিকের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে মোহনবাগান।
২০১৪ সাল পর্যন্ত যদিও ইস্টবেঙ্গল কোনো আর্থিক সমস্যার মধ্যে পড়েনি। ইউবি গ্রুপের প্রিন্সিপাল ওনার হিসেবে সংস্থার ৪২.১ শতাংশ শেয়ার ক্রয় করে হেইনেকেন। তাতে অবশ্য লালহলুদ শিবিরের স্পনসরশিপের টাকা আটকায়নি। সেই সময়ে ক্লাবের একজন অন্যতম ডিরেক্টর বিজয় মালিয়ার শেয়ারের অংশ ছিল ৩৭.৫ শতাংশ। তবে ২০১৭-১৮ মরসুম শেষ হওয়ার পর এই সম্পর্কেও ব্যাঘাত ঘটে। ২০১৮ সালের মে মাসে ক্লাবের আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠকের সময় ইউবি গ্রুপ ঘোষণা করে যে স্পনসরশিপ বাবদ তারা ইস্টবেঙ্গলকে মাত্র ১.৫ কোটি টাকা প্রদান করবে, যা সেই সময় লালহলুদ শিবির যে অর্থরাশি স্পনসরশিপ বাবদ পাচ্ছিল এটা তার অর্ধেকেরও কম। প্রত্যাশিতভাবে ইউবি গ্রুপের শর্ত মানতে রাজি হয়নি ইস্টবেঙ্গল। জয়েন্ট ভেঞ্চার সংস্থা থেকে নিজেদের ৫০ শতাংশ মালিকানা ফেরত দেয় ইউবি গ্রুপ। সেই সঙ্গে স্পোর্টিং রাইটসও ফেরত দেওয়া হয়। তারপর ফের বেঙ্গালুরু ভিত্তিক ব্যবসার পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থা কোয়েস গ্রুপের সঙ্গে স্পনসরশিপ চুক্তি স্বাক্ষর করে ইস্টবেঙ্গল। এর ফলেও একটি যৌথ উদ্যোগে সংস্থা নির্মাণ করা হয়। ইস্টবেঙ্গল এবং কোয়েসের এই নয়া সংস্থার নাম দেওয়া হয় কোয়েস ইস্টবেঙ্গল এফসি প্রাইভেট লিমিটেড। এই নয়া সংস্থায় ৭০ শতাংশ মালিকানা ছিল কোয়েসের এবং ৩০ শতাংশ ছিল ইস্টবেঙ্গলের। কো-স্পনসর হিসেবে ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে থাকতে চেয়েছিল ইউবি গ্রুপ। তবে সেই প্রস্তাব খারিজ করে ক্লাব এবং তাদের নয়া বিনিয়োগকারী। তবে কোয়েসের সঙ্গেও ইস্টবেঙ্গলের গাঁটছড়া দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। মাত্র দুটি মরসুমের পরই ক্লাবের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে কোয়েস।
বর্তমানে ইস্টবেঙ্গলের কোনো টাইটেল স্পনসর বা বিনিয়োগকারী নেই। রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, বর্তমানে একাধিক পক্ষের সঙ্গে স্পনসরশিপ চুক্তি নিয়ে আলোচনা করছেন ক্লাব কর্তৃপক্ষ। এটা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে মোহনবাগান এবং ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে ইউবি গ্রুপের স্পনসরশিপ চুক্তি যথাক্রমে ২০১৬ এবং ২০১৮ সালে শেষ হয়েছে। ইউনাইটেড মোহনবাগান প্রাইভেট লিমিটেড এবং কিংফিশার ইস্টবেঙ্গল ফুটবল টিম লিমিটেডের শেষ ব্যালেন্স শিট যথাক্রমে ২০১৮ এবং ২০১৯ সালের ৩১ মার্চ দাখিল করা হয়েছিল।
Biswajit Manna
News freak, sports enthusiast, translator, amateur writer and avid reader. I live and breathe for Sports!
রিড লিস্ট
- অযোধ্যায় রাম মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হওয়ার পর উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন দানিশ কানেরিয়া
- আইপিএল ২০২০: করোনা থেকে বাঁচতে পাঁচতারা হোটেলের বদলে রিসর্টে থাকতে চায় দলগুলি, অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করতে পারে মুম্বই ইন্ডিয়ান্স
- আইসিসির ওডিআই ক্রমতালিকায় শীর্ষস্থান বজায় রাখলেন বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মা
- কেউ বাবর আজমের কথা বলছেন না কারণ তিনি বিরাট কোহলি নন: নাসের হুসেন
- এক ওভারে ৩০ রান দেওয়ার কথা এখনো ভুলতে পারেননি ইশান্ত শর্মা
মন্তব্য